শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০০৯

পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক, সরসিজ আলীম _এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশকাল: ২১শে বইমেলা ২০০৯, ঢাকা। প্রকাশক: ভাষাচিত্র, প্রচ্ছদ: অতনু তিয়াস, পৃষ্ঠা: ৪৮, মূল্য: ৬০ টাকা মাত্র।

        
একাকী রাখঢাক

মাঠের একাকিত্ব জুড়ে ঘাস, মাথার উপরে কাক,
কথা হচ্ছিলো যা সবি তো সব-ই তা রাখঢাক।

আলো তরঙ্গ রোদ্দুর স্রোত মাঠে মাঠে ঢেউ,
বান্ধব ঢেউ, রোদ্দুর স্বজন, আর ছিলো না কেউ।

মাঠে ময়দানে হাট, কেউ কেউ খই ভাজ খই ভাজ,
একাকী রাখঢাক, তোমার এখানে আছে কি কোন কাজ?

ধুলো-স্নান ডানায় মাখছে চড়ুই পাখিটি রোজ রোজ,
বন্ধু-বৌয়ের বাড়া-ভাতে ভাগ বসিয়ে ভোজ।

মান্যবর সাধু! সাধু মান্যবর হে! ভাতের বদলে আলু,
পাখিদের বাসায় ইদানিং রেশনিং ব্যবস্থা চালু।

বন্ধু তোমার একাকী রাখঢাক, ফেরাও এবার বাড়ি,
যখন পাখিদের ডানা দূর-দ্বীপে সকল দিয়েছে পাড়ি।

যখন বন্ধ হয়েছে ধবল পাখিদের সকল উড়াউড়ি,
শুধু একাকীত্ব জুড়ে ঘাস, মাথার উপর চাঁদের-মা বুড়ি।











সে আলো 

যে বাসিয়াছে ভালো
তার জন্য সকল আলো;

আলো পড়শি বাড়ির ছাদ,
অল্পই গল্প হৈ-হল্লা অবাধ।
গল্প, বন্ধু তোমার কণ্ঠ ভরাট,
করো বইয়ে গোলাপকুঁড়ি মলাট।

মলাটের নিচে রাখা ভালোবাসা
আলো ছুঁতে যাওয়া আসা।
আসা যাওয়া কোন পথে গো,
কাঁটার আঘাত কোন বনে গো।

বনে বনে ফুলের আলোড়ন,
পক্ষি সকল ভ্রমর গুঞ্জরণ।
গুঞ্জরণ, এই পাড়াতে অথৈ কেন জল?
এই ছুঁড়ি তুই আমার সনে চল।

চল তরুণী সমুদ্রে চল যাবি,
একটা কাচের ঘর যেথা যথা পাবি।
পাবি শ্যাওলা আর জেলি ফিশ,
রাঁধিস গো মেয়ে মাছভাত, ভাতমাছ রাঁধিস।

বাঁধিস চুল আর রাঁধিস আর বাঁধিস চুল,
বাঁশির সুর ভাসে এ-কূল আর ও-কূল।
এ-কূল ও-কূল বাঁশির সুর ভাসে,
এইমধ্যে এইস্বপ্নে রাজার কুমার আসে।

আসে সে, রাজার কাচের ঘর,
সেই ঘরে দুইটি নারী-নর।
নর-নারী থাকে দুধে ভাতে,
আমরাই কি সকল উত্পাতে?
উত্পাত ছেড়ে চাঁদের হাত ধরি,
গাছে ছাদে শাদা শাদা পরী।
ভালো যে বাসিয়াছে, যে বাসিয়াছে ভালো,
বেশ তো সে আলোক, সে আলো।











হাত রচিত 

তোমাকে ভালবাসতে হলে একটু বেশি বেশিই
বাসতে হবে,
ব্যাস্ত নেটওয়ার্ক, ওয়েটিংয়ের দীর্ঘলাইন
আলগোছে নিপুণ
এবং লাফিয়ে ডিঙিয়ে পেরিয়ে অবশেষে
ফোনটি রিসিভ হওয়ার পর
যেন শুনতে না হয়;
তোমার সংক্ষুব্ধ মাথাব্যথা,
খাড়া দুটি শিঙ গজিয়েছে তোমার আলু ও তালুতে।

যেন শুনতে না হয়
যথেষ্ট মেঘ নেই গগন ও তটিনী জুড়ে
কথার পেখম তুলতে পারে চাঁদময়ূরী।

যৌনালাপেও সায় সাড়া মিলছে না রবি থেকে শুক্র।

তবে অদ্য আলাপ হতে পারতো
পানকৌড়িদের সুদৃষ্টির দূরত্ব বিষয়ে,
বসতভিটার ঠাইঠিকানা সুনির্দ্ধারণ প্রসঙ্গে,
দিনকে দিন ইহাদের প্রজনন পরিবেশ
বিলুপ্ত হচ্ছে বলে চাউর হচ্ছে বলে
উদ্বেগ, কালি ও মাছি বিনিময় করতাম আমরা।
একজন যুবকের স্বপ্ন পিয়াসের দুচোখ
নিয়ে কথা বলতে, দৌড়তে, জলঘাসের ক্রন্দন
লিখতে ও পড়তে পারতাম আমরা
যার দু’চোখে ও পিয়াসে
দীর্ঘ লম্বা, অতিদূর গাঁও ও নগরীর
রয়েছে সুপেয় সুপ্রভাত আলোকধারা,
এ আলো কখনো ঘুমিয়ে পড়ে না।
চে’র চেয়েও উজ্জ্বলতম আগুন।

কোকিলমণি, আজ কাল পরশু
তোমার সংক্ষুব্ধ মাথাব্যথাটি বহাল রেখেছে
খাঁড়া দুটি শিং।
তোমার সাথে কথা বলা হয় না,
কথা বলা যাচ্ছে না, যাচ্ছে না বলা কথা,
এই ভালবাসার ক্ষেত্রে
মনের মধ্যে তীব্রগতির দৌড়ঝাপ করতে
বডি ফিটনেসটা খুবই জরুরি এবং লজ্জা নিবারণ।

তোমাকে দোল ও সাথে দোলনচাঁপার জন্য একটু বেশি বেশিই
আরো একটু বেশি বেশিই
দিতে হবে দে দোল ও দোলনচাঁপাগুচ্ছ।
যেন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য লাল লাল
কাচের চুড়ির রিনিক ঝিনিক হয়,
যেন কাঁচাবাজার বসে কাউন্টারে
পা ছড়িয়ে, বেশ সাজগোজ করে,
যেন সাজগোজটি কম্পিউটারে মনোযোগ রাখে,
আর হাসি মুখ ছড়িয়ে থাকে চারপাশ,
আর বাতাস হেঁটে হেঁটে পার হয় উদোম গলি।
যেন কম্পিউটারের বাটনে রাখা হাত
আর রোদেলা আঙুলগুলো ও নদীগুলো
আর উঠানামা দেখতে দেখতে
হারাতে হারাতে লাইনের খুব পিছনে
ও জঙ্গলা কুয়োয় না পড়ি না ডুবি,
যেন ঘামে ভিজতে ভিজতে জামার বুকে পিঠে
ফুল ফোটাতে ফোটাতে
বেহুস না হয়, না হয় ফারজানা হক লিসা
ও তার প্রিয় বান্ধবী তাহিরা ইয়াসমিন,
আর যেন
চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেবার মতো
হাতের কাছে কিছু শীতল পরশ চটজলদি সহজে মেলে,
আবার কাঠ ভেজানোর জন্য সুপেয় কিছু থাকে অবশিষ্ট।

যেন উত্তর পকেট থেকে দক্ষিণ পকেটে রাখা
ইমারজেন্সিটা
আর তারে আটকানো শুকিয়ে ওঠা কাপড় চোপড়
আর ক্লিপগুলো খুলে নিয়ে তুলে নিয়ে
পালিশ করা জুতোগুলো প্যারেড করতে করতে
খেলার মাঠে ঘুড়িমন ওড়ানো ছাত্রদের সাথে
গলাগলি করতে করতে ‘ভাই’ বলে ডাকে,
আর শিক্ষকদের স্যালুট দিতে দিতে
ছেড়ে যেতে পারে বেলতলা
এবং খুবই মনযোগী হতে পারে লন্ড্রিখানায়।

যেন দুর্নীতির মাপকাঠিটা সোজা-বাঁকা না হয়,
যেন যাহাই বুধ তাহাই শুক্র না হয়
যেন যাহাই কুড়ি তাহাই বিশ হয়।

তোমাকে উন্মোচিত করতে একটু বেশি বেশিই
ভালবাসা হাঁটবো, গাছে চড়বো,
যেন তুমি সোজাসুজি বুঝতে পাও, ধ্বনি পারো,
খেতে পরতে পাও
কোনটা তোমার মাটিবন্ধু আছে,
কোনটা তোমার আকাশ বন্ধু হই,
কোনটা তোমার চাঁদবন্ধু আসবে কুটুম,
কোনটা তোমার গাধাবন্ধু
বাজায় বাঁশি দূর গাঁয়ের ও-প্রান্তে।

পুতুল বিয়ের দলে তুমি ছিলে না,
‘পাকা আমের মধুর রসে রঙিন করা’
মুখগুলোতে ঝড়ের দিনে মামার দেশে অন্যরা সব ছিলো,
অন্যরা কেউ হবে
তোমরা মাটিবন্ধু অন্যরা কেউ তবে।

যেন আমরা দূর্বাঘাস এমন সময়
ভিজছি কুয়াশায়,
কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে শিশির জড়ো করি,
জড়ো করছি শিশির,
আকাশের রোদের হাত এমন সময়
রোদের হাতটি আকাশের
আমাদের দুইভাগ ক’রে
কুচি কুচি টুকরো টুকরো কেটে কেটে
ছড়িয়ে দ্যায় আকাশে
আমাদেরকে উড়িয়ে নেয় আকাশে।

আমরা ওগো আকাশবন্ধু হলাম।

ঢেউ তুলে হেঁটে যায় চাঁদের ভেতর নদী,
নদীর হাত আলোক ধারা, হাত বাড়াও যদি।
হাত বাড়াও, বাড়াও হাত
তুমি হয়ত চাঁদবন্ধু খোঁজ,
রেখেছো বেঁধে চুল
কেউ এসে খসিয়ে দেবে খোঁপা,
খোঁপার সাথে ছড়িয়ে যাবে শস্যের কণা, ঢেউ,
হীরা চুনি পান্না,
আমার হাতে শস্যের ঘ্রাণ কই?
আমি তোমার চাঁদবন্ধু তো নই,
কেমনে তোমার চাঁদবন্ধু হই, কেমনে হই?

যার সাথে জল তোলা-ফেলা, ঘাম ঝরছো,
যার সাথে ক্লান্ত হও,
নগ্ন পুষ্প গান গাও,
যার সন্তান ধরো, বাঁধো, সাজাও, পুচ্ছ নাচাও,
আর করো
শস্যের ক্ষেতসহ যৌথ খামারের দাবী
যাহার কাছে,
উহাই তোমার উত্তম গাধাটি।

সেই তো অনেক অনেকটি দিন হলো
তোমার কণ্ঠে শিশিরের শব্দ,
বরফেরা জমাট গেরো,
বন্যার পানি ঢুকে পড়ছে তোমার নাক অবধি,
কথাটথা বলতে বারণ।
দাঁত কেলানো ড্রেনে বাদামী ভেসে যাচ্ছে
লাল নীল গন্ধ, লাল পিঁপড়ের ডাঁই,
মদের পিসাব, পলিথিনের ঠোঙা,
আর কুড়িয়ে নিচ্ছে রনবীর টোকাই,
ও বোকাসোকা নাক কোঁচকানো পথচারী,
এবং আদমজী চটকলের চটপরা ভিখেরি,
এক সময়কার সোনার মেডেল পাওয়া শ্রমিক।

ড্রেনের উপর ভ্যানের উপর নিশ্চুপ খাবার,
ধোঁয়া ওড়া নেই,
ডানে বামে সামনে পিছনে উপর এবং নিচে
সিটি কর্পোরেশনের পাঙখা ধুল ছিটায়,
ঠনঠনে ভাত নুন মরিচ হাতে হাতে
গিলে নিচ্ছে ঝুলেপড়া জিভগুলো, আমিও খাই,
ও আমার শ্রমিক বন্ধুরা তোমরা আমার ভাই,
আমি তবে দু’পয়সা বাঁচাই।

পত্রিকাস্টল, সারিসারি অদরকারী ভাণুমতি,
বহুজাতিক কোম্পানির ম্যাগাজিন,
বিজ্ঞাপনের ঘুড্ডি ওড়ে,
বিজ্ঞাপনের মডেল ওড়ে লাল নীল সুতোয় বাঁধা,
মডেল বালিকা স্তন,
স্তনগুলো আর রসেভরা যৌবনগুলো
নেড়ে চেড়ে রেখে আসি, শুধু ফিরে ফিরে চায়,
ও আমার বালিকাস্তন, দু’পয়সা বাঁচাই।

পরিচিত রিকশাঅলার সেলামগুলো,
জিয়াফতের চোখগুলো
অগ্রাহ্য ক’রে হাসি হাসি মুখে পায়ে পায়ে দ’লে
পায়ে ঠেলে মিলাবুবুর কণ্ঠে দুলে
...বাপুরাম সাপুড়ে... করতে করতে হনহন করে হেঁটে যাই।
ও বন্ধু ও আমার রিকশাঅলা ভাই
যাহোক দু’পয়সা বাঁচাই।

ঘাম গন্ধ, বিছানা বালিশে তেল গড়ানো,
রাতের ঘর হীম-আঁধার, উলঙ্গ কুৎসিত,
বাড়ির কাছাকাছি হতেই নেড়িকুত্তাটি পুচ্ছ নাচায়,
‘আজো দেরি করলে বাছা!’ টি লেজ নাচায়,
মাসকে মাস বাড়িঅলার সিঁড়িতে পা টিপতে টিপতে উঠি,
বাড়িভাড়া টিপতে টিপতে দরোজার চৌকাঠ ও ডাঙায়
আছড়ে পড়ি,
হাঁপর টানি, ছাড়ি...
দরোজা তালা চাবি টিপতে টিপতে
গৃহে প্রবেশ
পিঁপড়ের উপনিবেশ,
এ গৃহে প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে পিঁপড়ের সারি,
ও হে পিঁপড়ে বোন, পিঁপড়ে ভাই,
হে হে খেচে দু’পয়সা বাঁচাই।

লক্ষ্মী বৌটি সোনার বরন...
সব মিলিয়ে চোখ ফেরানো দায়,
তবু চোখ বেঁধেছি, ঘাড় ঘুরিয়েছি
লতা পাতা পুষ্পের বন থেকে,
পাঠিয়ে দিয়েছি জোড়া পাখিদের ঘরকন্যা দেখতে,
পুকুরজলে হাত ফসকে ফেলে দিয়েছে
নিজের সংসার,
শুধু এমনটি হয় রাত রারোটার পর
ফোনসেক্স করি,
(প্রিয় পাঠক একথা কাউকে বলবেন না দোহাই)
ও হে পুকুরের জল, বোন আমার, দু’পয়সা বাঁচাই।

যতোসব এত্তোসব এবঙসব ক’রে
যাহোক তাহোক এবঙহোক ক’রে
ও একটি মুখের হাসির জন্যে অস্ত্র ধরা চায়,
...পয়সা জড়ো করি,
দু’পয়সা দশ পয়সার ব্যালেন্স করেছি জমা,
যেন আমাদের কথা বলা না হওয়া পর্যন্ত,
বঙ্গোপসাগরে চাঁদের গর্জন শেষ
না হওয়া পর্যন্ত,
অনর্গল গল গল
গড় গড়
বিরামহীন অবিরাম
আমাদের কথা-বচন-জবান
পাল তোলা নাওয়ে দূর দরিয়ায় ভাসতে পারে।

যেন একজন যুবকের পদ্মার ইলিশ
হ’য়ে ওঠা,
গাছে গাছে দোয়েলের শিস হ’য়ে ওঠা,
একজন বিপ্লবী না হয়ে ওঠার
বাস্তব পরিস্থিতি মূল্যায়নে
যথেষ্ট সময় কুলকুচি করতে
উপচে দিতে
গড়িয়ে দিতে
পারা যায়।

কোকিলমণি, তোমাতে গুপ্তধন পেতে হ’লে
একটু গভীর তন্ন তন্ন খনন করাই ভালো,
যেন তোমার মাথাব্যথা ভালো না হ’য়ে
পারেই না।
যেন তোমার মাথা থেকে খ’সে পড়ে
মজবুত খাঁড়া দুটি শিং,
আর প্রতিদিন আকাশের গা থেকে
খ’সে পড়ে চাঁদের ফসিল
যেন আলো যুবককে নিয়ে রাতের পর রাত
ক্লান্তিহীন আমরা
রমণাবদ্ধ থাকতে পারি, ওম পারি,
রমণাবদ্ধতার ওম দৌড়ে চি-বুড়ি ছুঁই,
চি-বুড়ি যেন বুঝতে পারে
মাওয়ের চিন্তাধারা কিভাবে মাওবাদ হ’লো।

হাওয়ার দ্বীপে চাঁদ সূর্যের আলোকের নিচে,
গরীর ঘরে, নারী ও শিশুর
বলিষ্ঠ পুরুষ ও সাহসী প্রেমিকার জঠরে ও চোখে,
ফসলের সবিস্তারে,
নদী ও নৌকায়
ভয় ও নিনাদ সমেত যৌনরোগ ছড়াচ্ছে
মার্কিন কনডমের জোরপূর্বক আচরণ,
তোমাকে এমনই তারকারাজির আলো দেবো,
দেবো তারকারাজির আলো তোমাকে এমন,
যেন কনডমের ভিতর ঢুকে সুনামী ও সিডর
পাল্টা আঘাত করতে পারে
মারি-ক্যার সামরিক ঘাটিগুলোতে,
শোন হে, মারি-ক্যা ভাই,
সবার উপরে কনডম সত্য
তাহার উপরে নাই।

যেন বলিভিয়ার জঙ্গল থেকে উঠে আসা একজন,
দ্বিতীয় পৃৃথিবীর প্রথম সূর্য উঠে আসে,
হাতে রাখে হাত
কালোহাত শাদাহাত ঠুটোহাত দীর্ঘহাত
মাটিহাত শস্যহাত
পুষ্পহাত পাথরহাত
রোমশহাত নখহাত
হালুমহাত অনশনহাত
গাড়িহাত বাড়িহাত
গাড়িহীনহাত বাড়িহীনহাত
শ্লেট-পেন্সিলহাত চক-ডাস্টারহাত
কলমহাত কম্পিউটারহাত
নোলকহাত নোলকহীনহাত
একতারাহাত হাপরহাত......
হাতে হাত
এক জোড়া হাত
হাত রচনা করে
রচিত হয়।

কোকিলমণি, ওগো আমার কোকিলমণি,
আমার ফোনটি আমার জরুরী ফোনটি রিসিভ ক’রো তুমি।










শাদা জিরাফতলা

শিশিরদের ফর্সা পা দেখতে আসার কাছে,
বৃষ্টিদের সাঁতার শিখতে আসার কাছে,
পাখিদের দূরপাল্লার গাড়িদের টিকিট কাটতে
আসার কাছেই বেশ পুরাতন বাড়িটি।

বেশ পুরাতন বাড়িটির কাছে বকুলতলা আছে
বকুলতলার কাছে শাদা জিরাফ আছে
শাদা জিরাফের কাছে পান চিবানো আছে
পান চিবানোর কাছে ‘কেমন আছিস ভাই’ আছে

‘কেমন আছিস ভাই’ র কাছে লেখাপড়ারা আছে
লেখাপড়াদের কাছে বাতাসে কানপাতা আছে
বাতাসে কানপাতার কাছে বকুলঝরা আছে
বকুলঝরার কাছে ঝাঁপ দিয়ে পড়ারা আছে

ঝাপ দিয়ে পড়াদের কাছে দৌড়তে দৌড়তে আসা আছে
দৌড়তে দৌড়তে আসাদের কাছে কাড়াকাড়ি আছে
কাড়াকাড়িদের কাছে সুই-সুতো আছে
সুই-সুতোর কাছে মালাগাঁথারা আছে

মালাগাঁথার কাছে মালা পরাবার আছে
মালা পরাবার কাছে মালা পরে কেউ আছে?
মালা পরে কেউর কাছে সদা প্রস্তুত আছে
সদা প্রস্তুতের কাছে সেই লেখাপড়া আছে

লেখাপড়ার কাছে পরীক্ষা শেষ হ’লো না আছে
পরীক্ষা শেষ হ’লনা-র কাছে
এসো বসো তামাক খাও আছে

এসো বসো তামাক খাও মতিহার আসে
মতিহারের কাছে জিজ্ঞেস করার আছে
জিজ্ঞেস করার কছে তন্বি দিদি আছে
তন্বি দিদি, ও তন্বি দিদি, বকুলতলা যাবে?
বকুলতলা, তোর পরীক্ষা শেষ হবে কবে?












বনমালী

ওহে বনমালী, কে নেবে তোমার লিপ্সার দায়?
কে নেবে ব্যাটা তোর নুন, হাওয়া আর সিসা, ছাই?
একদা বেপরোয়া ঠোঁট, তার সতেজ ডালপালা
রেখে গিয়েছিলো; তোর কাজ ছিলো পায়ে পানিঢালা।
‘ওরে ও দখিন হাওয়া...’ পেড়েছিলো পুষ্পের ডিম,
তা’ দেওয়া কাজ ছিলো তোর, ওম জ্বালানো পিদিম!
দিকবিদিক হ’য়ে ঢুকে পড়তে পারে খরগোশ,
বুকে টেনে নিস, কাছে ঘেঁষতে দিবি না বুনোমোষ।

বাধা দিলি কই? বুনোমোষ তছনছ করে সবি,
শেয়ালেরা গর্ত, গোবরে, উই, পিঁপড়ে করে ঢিবি।
রে বনমালী! লাল ফিতা ফাইলে দিস দস্তখত
শাদাপৃষ্ঠা কাগজে, গিলিস গেলাস গেলাস মদ।
ব্যাটা আর দাদা কোম্পানিতে চাকুরি, বুটপালিশ,
তো, পেঁচারাতে গায়ে দখিন হাওয়া- বাড়ি ফিরিস...












মৃত্যু ও তালপাতার কাব্য

‘খুন হয়েছে যে-ব্যক্তি সেই সবচেয়ে সম্মানিত কেননা সে খুনি নয়।‘
-কাহ্‌লিল জিবরান
...তারপর? তারপর সাদা পাতা।
সাদা পৃষ্ঠা পাতা, ঝরা তালপাতা
উড়তে লাগলো ঝুলে বায়ূ-হাত,
দিঘি জলেতে করলো প্রাণ-পাত।

পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক,
দিঘি জলটি লিখছে মোটা দাগ।
দিঘির জল লেখে মোটা দাগকে,
‘যে’লম্বা মোটা দাগ ফেলেছিলো ‘কে’।

‘কে’ চলে যেতে যেতে আদর দিলো
বটগাছটিতে, মা বলে ডাকলো,
বড় ছোট সবাইকে ডাকলো- ভাই,
ও নিম ও তেতুলকে বললো- ‘যাই’।

নিম ও তেতুল বন্ধু বুঝি তাঁর ?
বন্ধু, ধরে রাখতে যদি ই-কার !
আদরগুলো রেখে দিঘির জলে
‘যাই’ কী কখনো যেতে পারে চলে!

আদরগুলো দাগ হ’য়ে রইলো
দিঘির জলে, ও লিখতে পারলো।
তালপাতা, যতই মেজাজ দ্যাখা,
চলতে থাকবে এই দাগ লেখা।

পায়ের দাগ লিখবো তালপাতা,
দেখে পায়ের দাগ অপেক্ষারতা
মা, মেয়ে আর বোনের কাছে পারো
যেতে, প্রিয়তমার কাছে আরো।

বাবার কাছে ও ভায়েদের কাছে
হাতের পরশন দাগের কাছে।
বুকের ওম দাগ শস্যের কাছে,
দ্যাখো, বৃষ্টি ছাড়া নদী তবে বাঁচে?

এক বৃক্ষ দুলে উঠলে সবটা
বন দুলতেই থাকে, কথা কয়,
এক রাত কেঁদে উঠলে ‘কে’ র মা-টা
বোন ভাই- রাত ডেকে ডেকে যায়...।

ফিরে পেলো বৃক্ষ তার ভাষাগুলি,
‘বাছা! ভাই! এইভাবে তুই গেলি!’
মেয়েটি বাবার মৃত্যুর বয়েসী,
তাকেও বলেনি- ‘আম্মু তবে আসি!’

‘আব্বু! আব্বু!’- বলে ডেকে ওঠে ছড়া,
দরোজায় কেউ নাড়ছে কি কড়া?
পথ পানে ফিরে চায় জনে জনে,
ভুল মন ফিরে আসে নিজ মনে।

মৃত্যু ও কান্নায় লেখা তুমি ছড়া,
মা গো, অত কী সহজ পিতা গড়া?
তবু গড়েছো একজন পিতাকে,
পিতা, তুমি আদর দিও ছড়াকে।

‘ভা’-ছাড়া- ‘ই’ হাতে লিখি একছত্র,
লিখি বর্গক্ষেত্রকে আয়তক্ষেত্র।
তালপাতায় লিখছে দিঘি, জল,
পূবের আকাশে আলো, ঝলোমল?











আমাদের বাবা 

বৃষ্টির পিছনে ঢিল ছুঁড়েছে কে?
ঢিল ছোঁড়া উড়াচ্ছিলো কুয়াশাকে।

গীতির পিছনে তো ছিলো কুয়াশা,
কুয়াশার পিছনে থাকলো বৃষ্টি,
বৃষ্টির পিছে শাদা বরন বক,
বকের পিছনে কৃষাণ থ’ দৃষ্টি।

থ’ দৃষ্টি বাবার বন্ধু হ’তে পারো,
বন্ধু সারারাত ঠাঁই দাঁড়াতেন,
তেঁতুল গাছের ছায়া গড়াতেন,
বাঁশবনের ফাঁকে ভোর আঁকেন।

ভোর হেঁটে হেঁটে মাঠেই গেলেন,
শাদা শাদা বক উড়িয়ে দিলেন।

উড়লো বক হাঁটুজলে নামলো,
একটি পুঁটির ঝাঁক লাফ দিলো,
লাফ দিলো বকের ঠোঁটে, ঢুকলো,
বকের পেটে প’ড়ে খিদে নামলো।

বাবাকে তো জিজ্ঞেস করতে পারো,
বকের পেট থেকে পুঁটিরা নাকি
ঝাঁকে ঝাঁকে আবার জলে নামে কি?
বক-পুঁটি এই খেলছে জল কি?

বাবা এমন সবে মজা পেতেন,
বাবা আকাশে ঢিল ছুঁড়ে মারেন,
বৃষ্টি ঢালেন, কুয়াশা ওড়াবেন,
বাবা তো যা-খুশি আবাদ করেন। 











আমাদের মা 

মেয়েটি অথবা নববধূটি এক সন্ধ্যায় শ্বশুর মানুষটির অজুর পানি দেবার পর পূর্বঘরের দ্বিতীয়তলায় সেজবাতি জ্বালায়, সেই সেজবাতিতে সরিষার তেল ও একটি শলিতার গল্প জ্বলতে থাকে ভীরুতা ও লাজের ভেতর, ভীরুতা ও লাজ গিয়ে বসে কদমবুচিতে, কদমবুচির মাথায় রাখে হাত, ...হাত...ধনে মানে পূর্ণবতী হও মা... ব’লে গল্প গড়াতে থাকে ঘর আলো করা ঘর-সংসার।

মানুষটি আসমানী পাঠশালায় প্লে-গ্রুপের ছাত্র, ছাত্রটি একটি টুপি পরা শিখেছে মাত্র, এই টুপি পরার মধ্যে বয়সের ব্যাপার আছে, কোন ধর্ম অধর্মের মধ্যে না ঢোকাই ভালো, আর মাত্রের মধ্যে শুয়ে-ব’সে থেকে সুদীর্ঘ দিনের পর চলে গিয়েছিলো বৃটিশ বেনিয়া, আর পাকিস্তানী বেদের সাম্পান ঘাটে ঘাটি ভিড়েছিলো, ভিড়েছিলো বঙ্গমাটি স্পর্শ করবার পর পরই জান নিয়ে জান খুইয়ে পালিয়েছিলো, পালিয়েছিলোর মধ্যে ঢুকে পড়তে পেরেছে ভুল পার্টিলাইন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কমিউনিজমের গা গতর হ’তে বেরিয়ে যাচ্ছে দখলদার লু বাতাস, লু বাতাসেরা বয়ে যাচ্ছে উঞ্চতা ও আদ্রতা দ্বি-ধারা, উঞ্চতাধারা দু’ বাঙলায় জোতদার মহাজন খতম করো বুনেছে দিকে দিকে, আর বুনেছেরা উড়িয়েছে ছাই, আর আদ্রতাধারা আমরা জানি কুসুমের বুক রক্ত গড়াগড়ি শ্বশুর মানুষটি, রক্ত গড়াগড়ি পূর্ণবতী হও মা’র কানে কানে গল্প ব’লে গিয়েছিলো- অন্তিম বাণী, গল্প বলাবলি ১৯৭৪-এ দ্বিতীয় বিপ্লবের চার হাত এক ক’রে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পৌঁছতে পেরেছিলো।

এখন আমরা পৌঁছতে পারবো পূর্ণবতী হও মা- আট সন্তানের জননীর কাছে, পূবের ক্ষেত থেকে আলো ও বাতাস এসে লুটোপুটি খায় জননীর আঁচলে- তা রান্না ক’রে খাওয়া হয় সকালের, আমাদের আঁচলে এভাবে দখিনের ক্ষেত উত্তরের ক্ষেত পশ্চিমের ক্ষেত থেকে যে আলো ও হাওয়া উঠে আসে- তা দিয়ে শাকভাত মাছভাত দুধভাত মিঠাইভাত ডালভাত ফলফুলরীভাতের...স্বাদ` তিনবেলা চারবেলা ভরপেট চিনে আমরা দশদিক চিনতে শুরু করেছি, শুরু করাগুলো নদীতে সাঁতার দিতে গিয়ে ডুব দিয়ে তুলে এনেছে তলদেশ ছুঁয়ে কাদামাটি, কাদামাটি দিয়ে জননী মোদের লেপাপোছা করেছে উঠোন, লেপাপোছা করা উঠোন পেরিয়ে আমাদের ঘুড়ি উড়োতে যাওয়া, উড়োতে যাওয়া আকাশ ছুঁতে পাওয়া, আকাশ ছোঁয়া ঘুড়ি- টাঙিয়ে রাখি মাথার উপর ছাদে, সারাপাড়া ঘর ঘর ঘুমানোর পর ছাদ থেকে ঘুড়িটি নেমে মায়ের চোখের ভেতর ঢুকে পড়ে, চোখ বয়ে চলে মগজের ভেতর, মগজের ভেতর হাঁকডাক ক’রে লোকজন জড়ো করে... কাঠ আনো, আলকাতরা আনো, পেরেক আনো, মাথা বানাও, লেজ বানাও, দেয়াল বানাও, পাটাতন দাও, হাতুড়ি মারো, জোড়া দাও, পাখা বানাও, আলকাতরা লাগাও, তেল ঢালো, ইঞ্জিনটা স্টার্ট করো... ঘুড়িটি তৈরি করলো নূহের জাহাজটি, ঘুড়িটি এবার পাল ওড়ায়, ওড়ানো পালে গিয়ে বসে, আর সারা জাহাজের ডানে বামে সব মিলেয়ে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল ভেসে বেড়ায়, এই ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের জাহাজটির গল্পটিই কি ব’লে গিয়েছিলো রক্ত গড়াগড়ি মানুষটি অন্তিম গল্পে? তাঁর চোখেও কি আঁকা ছিলো মহাপ্লাবনের ডর? ডর মায়ের মগজের ভেতর দিয়ে চোখের ভেতর দিয়ে তাঁর আট সন্তানের চোখে গিয়ে জ্বলে, জ্বলে হাঁকডাক দেবে দশদিক, দশদিক মিলে জাহাজটি ভাসিয়ে রাখতে হবে তো? হবে-তো বন্ধ দোয়ারে দোয়ারে কড়া নেড়ে নেড়ে যেতে পারো... কড়া নেড়ে যায় আমাদের মায়ের ছাদের উপর পূর্ণিমার চাঁদ বয়ে যায় সারারাত, সারারাত তাহার খোকারা কি শাদা শাদা পরীদের বাহু ধরিয়া নৃত্য করে? নৃত্য করো গো শস্যের দানা কোমর দোলাইয়া, দোলাইয়া নাচো গো অঞ্জনা, নাচো গো খঞ্জনা পাখি...











এই সবুজ 

একচল্লিশ বছরের পরমায়ুর নিচে চাপা পড়া ঘাস, একটি শালিক চাপা উল্টিয়ে দ্যাখে ঘাসের গা থেকে সবুজেরা নিখোঁজ, কিন্তু শালিক পাখি নির্বিকার।

শালিকের নির্বিকার গুম্ফ মনে করতে পারলো, নিখোঁজ সবুজ একদা যখন চলে যেতে গিয়েছিলো, তখন সে প্রথম চড়েছিলো একটা ঘাসফড়িঙয়ের পিঠে, ঘাসফড়িঙয়ের পিঠে চড়া সবুজ মনে করতে লাগলো; ... আমাদের ছোটনদী (চিত্রানদী) চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে... কিনা মনে করতে পারছিলো না, এবং ... সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে... কপোতাক্ষ নদকে তার ঠিক ঠিক মনে পড়ে কিনা, তাও বুঝতে না পেরে অথবা ঘাসফড়িঙয়ের পিঠে চড়ে নদ ও নদীর কথা ঠিক ঠিক মনে করা যায় কিনা বুঝতে না পেরে সবুজটি ঝাপ দিয়েছিলো একঝাঁক ঝাঁক ঝাঁক টিয়া পাখির ঝাঁকে।

টিয়া পাখির ঝাঁক গিয়ে বসেছিলো একটি বটের পাতায় পাতায়, একেকটি টিয়া সবুজকে পরিচয় করিয়েছিলো: এই হচ্ছে রোদের দাগ! এই হচ্ছে বৃষ্টির ছিটা! বটের তাঁবুতে যখন টিয়ারা ঘুমাচ্ছিলো তখন এই দাগ আর এই ছিটা সবুজকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলো মাঠে মাঠে, আর কোলাহল হারানোতে; একটি শামুকের খোলস পদদলিত হওয়া থেকে বেঁচে গিয়ে ডাক পেড়ে বলেছিলো, ‘এই সবুজ আমাকে চিনতে পারিস?’ সবুজ তাকে চিনতে পারেনি, পালিয়ে এসেছিলো দাগ আর ছিটাকে ফেলে, টিয়ার তাঁবুতে তখন চলছে ঠোঁটে ঠোঁটে চুম্বন, তাকে কেউ চুম্বন দেয়নি, সবুজের তো লাল মরিচ ঠোঁট নেই।
সবুজ থেকে গ্যালো বটগাছে একটি পেঁচার সাথে, পেঁচা তাকে শুনিয়েছিলো হয়তো পুরাতন নয়, এই সেদিনেরও নয়, বেশকিছু মিষ্টি স্বাদের পুঁথির পদ্য, কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে উত্তর আধুনিকতা, যাদুবাস্তবতা বা যাদুপরাবাস্তবতা; আর খুব ভালো লেগেছিলো বলে পেঁচার সাথে কাটলো বেশ কিছুদিন।

পুঁথির কাব্যখানিতে অটোগ্রাফ দিলো পেঁচা, বিদায় নিলো, বিদায় দৌড়তে গেলো, দৌড়তে গেলো দেখতে খেয়াটি, খেয়াটি গাঙ পার হতে ভুলে গেছে কিনা, খেয়া আবার দেখতে গেছে কিনা ঝোঁপের ভেতর, ঝোঁপের ভেতরে রাতটা কতটা গভীর হলো।

রাতটা গভীর হচ্ছে বলে পায়ে পায়ে বাড়ি মেরে বটের পাতায় টানটান শুয়ে পড়তে চাইলো সবুজ, তার আগে একটা বিড়ি ধরাতে চাইলো, চাইলো হাত বাড়ালো বটের খোমড়ের ভেতর, খোমড় তাকে ধাক্কা দিলো পাতার দুলুনি, দুলুনিসহ পড়লো নিচে, সবুজ এখন করবেটা কি ? করবেটা-কি কাঁদলো ক্ষণেক শিশিরের সঙ্গে, শিশিরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকলো কৃষকের বাড়ি, ঘুম ভাঙ্গালো মোরগের, আদর করলো, তখন মোরগঝুটির লাল দুলে দুলে উঠলো, মোরগঝুটির লালকে চুরি করতে চাইলো, তায়-কি হয়? মোরগঝুটির লাল কৃষককে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো, হাতমুখ ধোয়ালো, একটা বিড়ি ধরালো কৃষকটি, বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে চললো ক্ষেতের দিকে, সবুজ চললো বলদের পিঠে চড়ে, ক্ষেতের আইলে গিয়ে বসলো, বলদ-হাল চলতে শুরু করলো, হাল-চললো এবার একটা কেচোর সাথে গল্প বলতে লাগলো; -এই সকালে নুন পেয়াজ মরিচ পান্তাভাত কেমন স্বাদের হয়েছে, তিনবেলা পেট ভলে খেতে পায় কিনা, তার পেটে কোন অসুখ আছে কিনা, অসুখ হলে হাসপাতালে যায় কিনা, হাসপাতালের ডাক্তাররা সেবাপরায়ন কেমন, তরুণী নার্সরা ফোনে প্রেম করে সারাক্ষণ বলে মোটাপেট নার্সদিদিরা অভিযোগ করে কিনা, সবুজ পাশে বসে এসব কথা বলাবলি শুনছিলো। এবার সে কথা বলাবলির মধ্যে ঢুকলো, কেঁচোকে মাথায় হাত রেখে আদর করলো, আর জানতে চাইলো, -বিবাহপূর্ব তার কোন যৌন অভিজ্ঞতা হয়েছিলো কিনা, প্রথম যৌনসুখ তার শরীরে লেগে আছে কিনা, লালা ঝরাতে ঝরাতে লেগে আছে যৌনসুখ ফের মাটির গর্তে ঢুকে গেলো।
সবুজ ঢুকে গেলো এবার একটি মৃতের বাড়িতে, মৃতের বাড়িতে যতগুলো চিঠি আসে, চিঠির স্তূপ একটা বাক্সে ভরে সে রওনা হতে পেরেছিলো, চিঠিগুলো সে পৌঁছে দেবে দৈনিক পত্রিকাগুলোর অফিসে অফিসে, আসার পথে একটি ঘোড়ার লাল গলা ও কেন্নোর গায়ে পা পড়েছিলো, আর তাতেই কেন্নোটি পা উল্টিয়ে সেটিয়ে পড়েছিলো, কেন্নোর হাজারটা পা দেখে ভয় পেতে পেতে তার মনে পড়লো,- সে যে সাম্রাজ্যবাদের নাম শুনে আসছে, চোখেও কখনো দেখতে পেয়েছে; এই পাগুলো হচ্ছে তবেই মৃতের পা? এবার হড়কে পড়া হাজারকে কষে একটা লাথি লাগিয়ে ... উই স্যাল ওভারকাম সাম সাম ডে... গাইতে গাইতে প্রতিধ্বনি বইয়ে দিয়ে সবুজ বইতে লাগলো।
ঠিক ঠিক চিঠিগুলো আসতে পেরেছিলো কিনা জানা যাবে না, চিঠিতে কি লেখা থাকতে পারে সবুজকে জিজ্ঞেস করলে কি বলতে পারবে? সি কি চিঠিগুলো পড়েছিলো?
তবে এটুকু আমরা বুঝে নিতে পারি, চিঠিপত্রগুলোতে যে অক্ষর শব্দগুলো আছে, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে এর পিছে ও, ওর পিছে এ করে পত্রিকাগুলোর পাতাগুলোকে শাদাকালো রঙচঙা ভরানো হয়।

শালিক পাখি, এবার আমরা পত্রিকার পাতার ওলোট পালোট অক্ষর শব্দগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে চিঠিগুলো ঠিক ঠিক সঠিক করে বুঝতে চেষ্টা করি, আপাতত সবুজকে শাদা শাদা চাপা পড়া ঘাসের গায়ে বসিয়ে দিতে পারি, কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন বয়ে যাচ্ছে: সবুজকে আমাদের হাতের নাগালে পেলাম কিনা ...










সাপলুডু

পুঁট দিয়ে শেষ, খেলা পুঁট ফেলে শুরু,
ছাড়া বসন খেলছো, ওড়ে সাপলুডু।
পুঁট চলে গুটি চলে হাত চলে দোক্কা,
হাতেহাতে গুটি ঘোরে, ফ্যালে গুটি ছক্কা।
গুটি, ডাকছো তুমি ঘর পেরিয়ে ঘর,
এরপর মই, চোখ ঘর ঠোঁট ‘পর।
বসাও তবে মই প্রথম ঘর ধাপে,
ঘর মই উড়ছি ঘর, ধরলো সাপে।

সাপ গিললো, সাপের পেট থেকে নামি,
মই উঠছি তো নামি সাপ, পাগলামী।
পাগলামী, উঠা-নামা নামা-উঠা সুখ,
ঘামছে সুখ কাঁপছে, চাঁদ আলোমুখ।
চাঁদমুখ জ্বলে, চলে আলোমুখ খেলা,
সাপ চলে লুডু চলে মই ঘর বেলা।










হিটেরাদের গল্প শুনতে পাও 

০১. 

সিঁড়ির ধাপে ধাপে নামছিলো তুফান-ভারী
সিঁড়ির ধাপে ধাপে উড়ছিলো আকাশচারী,
আর পাপিয়াটা বকুল-ধান ছড়িয়ে দিলো
পিউকাহা গানের ভেতর, বন্ধুদের বাড়ি;
তখন কেবল ঝমঝমিয়ে আসারা আসে
তখন কেবল লাফঝাপ করতেরা আসে
তখন কেবল হনহনিয়ে আসারা আসে
তখন তবে উড়তে উড়তে আসারা আসে
তখন তবে ছুটতে ছুটতে আসারা আসে
তখন কেবল দুকূল ছাপিয়ে তবে আসে
তখন কেবল বাঁধ ভেঙে জোয়ারেরা আসে

তবে আঁধার কুঠুরীতে বয়ে চলারা ভাসে।

০২. 

তোমার কাঁধের ব্যাগ থেকে উড়ে উড়ে বিলি হয়ে যায় চিঠিগুলো প্রাপকের হাতে হাতে, চিঠিগুলো না খুলেও পড়ে নেয়া যায়; তাতে লেখা আছে ‘বাঁধভাঙা জোয়ার।‘

তোমার বুকের ওমটা ধার দেবে? যাতে পার করে দিতে পারি গহীন শীতকাল। বাঁধভাঙা জোয়ার! তোমার গাঢ় নিঃশ্বাসটা চোখেমুখে ঝাপটা দেবার জন্য ধার দেবে? যাতে আমি নিজের মধ্যকার উত্থানটা টের পায়। যাতে এক লাফে এভারেস্টটা ডিঙিয়ে আসতে পারি, আর কেউ যেন টের না পায়। যাতে খুব খুশি থাকতে পারি, -এমন হয়, যেন একডুব দিয়ে সমুদ্রের তলদেশটা ফুঁটো করে দেখার খুব খুব ইচ্ছে হয়। অথবা তলদেশটা ফুটো হওয়া পর্যন্ত ডুব দিয়ে থাকতে পারি। ফুটোটা হওয়া খুব জরুরী কেন জানতো?- এ দুয়ার দিয়ে মানুষগুলো পালিয়ে বাঁচতে পারে অন্ততঃ। বাঁধভাঙা জোয়ার, তুমি এখন বুঝতে পারছো তো! তুমি এখন রাজি হলেই মানবজাতিকে রক্ষায় একটা শেষ চেষ্টা করা যেতে পারে।

আর যদি সফল হই, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ধারগুলো অস্বীকার করতে বাধ্য হবো একদিন, কিন্তু তোমাকে নয়। কখ্‌খনো নয়।











রৌদ্র-পোড়া 

অনেক জলের গভিরে লুকানো কাদা-
এই সম্বল,
এই সম্বল নিয়ে তালপাতাটি
দীর্ঘদিন উড়িয়ে যাচ্ছে
বায়ুভরা বেলুন
আর যৌনতাঁত
আর এবাদত সাঁতার
আর হাসিহাসি মুখ

অনেক ছাই-চাপার তলে লুকানো আলো-
এই রোদনটুকুই
পোড়া কপালের বেশ উপরে
বুকের তল্লাটে রেখে
পাখি ডাকাডাকির খোমড়ে
ঘুমাতে পারবে-
হ’তে পেরে বিবাগী রৌদ্র-পোড়া
কেউ একজন
অতঃপর অনেকে











গান হও 

প্রথমে বর্ণনা করি- জলের বিলুপ্তি ঘটা, কাদালেখা,
কাদার ভেতরে ছবি আঁকা, বাসুকির ফণা তোলা দেখা;

দেখতে দেখতে সবুজ ধানক্ষেত, দূর গগনে আলো,
আলো নামলো নদীর কূলে কূলে, বাঁশির মন জুড়ালো।

প্রথমে বন্দনা করি পান্তাভাতে সরষে বাটা ইলিশ,
মাথার উপর সূয্যি-ঠাকুর মুষ্ঠি-মেঘ ছায়া ফেলিস;

সালাম নিও গো বন্ধু সকল, সালাম আমার মালিক,
ফসল কাটার গানের ভেতর জোড়ায় বসে শালিক।

শালিক নাচে আর ধান কাটার হেম রঙ গীত গাওয়া,
দূরপাহাড়ে ধুলো ঝেড়ে এমাঠে নেমেছে রোদহাওয়া।

কাটছে ধান হেমন্তের চাঁদ, বৌটি ফিরেছে সংসারে,
সংসারে বাতি, ফিরলো মেয়ে শহর হয়ে চুপিসারে।

তারপর বর্ণনার কেশে হলো বেণী, দোলে সারা পাড়া,
সারাপাড়া শস্যপাড়া গান গেয়েছে, গান কি লক্ষ্মীছাড়া ?











মাঝি 

গরিব ঘরে ঝিমধরা কলস কাত করলে
‘রহিল গোপন’ গড়িয়ে বের হ’য়ে পড়বে,
আর তার পিছে পিছে ছুটতে থাকবে ‘খিদে পেট’।
আর ছোটাছুটির পথে পড়ে যদি
কেউ একজন মাঝি ,
মাঝির পেটের ভেতর ঢুকে যাবে ‘খিদেপেট আর রহিলগোপন’।

মাঝির উদরের ভেতর তীব্র দহন গড়ানো-
উদরের ভেতর শিকারীর তর্জন গর্জন আর
উদরের ভেতর শিকারের বিপন্ন ছোটাছুটি,

মাঝির কোন স্রোত নেই, স্রোতে ভাসা নেই যে-
গড়িয়ে দিতে পারে তীব্র দহন কলস!

তুমি মেয়ে স্রোত গড়াতে পারো? খেয়া ভেসে যাবো।














সেনবাড়ির মেয়েরা ঘুড়ি 

মাঠের পাশে মেঠোপথের অদূরে ইস্কুলভবনটি
সবুজ খাম হ’য়ে থাকে,
বন্ধুর কথা মনে পড়লে
খামের ভেতর নীলচিঠি ঘুড়ি হ’য়ে ওড়ে।

প্রথম ক্লাস থেকে দশম শ্রেণীর কাছাকাছি
সেনবাড়ির পথ,
সেনবাড়ির পথ কি নীলচিঠি ?

মীরা রাণী সেন, কবিতা রাণী সেন ঘুড়ি হ’য়ে ওড়ে;
‘এই বৃষ্টিতে একটু বসে যা-না আমাদের বাড়ি!’
এত এত রোদের ভেতর বাড়ি ফিরতে কষ্ট হয় না তোর?’
সেনবাড়ির মেয়েদের ভালোলাগাটুকু,
ঠোঁটের উপরে ঘাম, লালটিপ ঘুড়ি হ’য়ে ওড়ে।

পাশের ঘরে একা একা ঘুমের বৌটি দুঃখ লেখে,
দুঃখগুলো ঘুড়ি হ’য়ে ওড়ে
কোন এক ইস্কুলভবনের ছাদে।











মৃতের পা 

যতনের গভিরে
লুকানোর অতলে
দ্রাক্ষালতা ও ফুল

পরিলাম গলায়
রাধিকার গীতিকা
নক্ষত্রের অনল

আর চোখ ধাঁধানো
মেয়েগুলো পালালো
মৃতের পা রূপসী

আর মনে পড়লো
রাত হলে গভীর
দুখ হীম কলসি











মৃতদের রূপসী পা 

এইসব কী ঠিক হচ্ছে বাইস্কোপের মেয়ে!
ধুধু বালুচরের মধ্যে
সমুদ্রের জলরাশি
ঝাঁকে ঝাঁকে ফণা তুলে দৌড়তে লাগলো।

কিছু না ভেবেই ধুধু বালুচর ঢুকে গেলো
সূর্যের পড়ার টেবিল গড়িয়ে
রান্নাঘর অব্দি;
বাধ্য হয়েই সূর্যটা নেমে পড়লো
পাহাড়ের মাথার উপর,
আর পা পিছলে গড়াতে গড়াতে
এসে পড়লো লাল গোলাপে,
মোরগের লালঝুটিতে দুলতে লাগলো।

মাছেরা গান শিখতে যাচ্ছে পাখিদের কাছে,
পাখিরা জলের তলে
ঘর বাঁধা শিখে নিচ্ছে,
ঠিক হচ্ছে কী এসব মৃতদের রূপসী পা !

এইসব কী ঠিক হচ্ছে মেয়ে, রূপসী মেঘ!
আমার জাতগুষ্টি উদ্ধার
করবে বলেছো বলে-
আমার বুকের মধ্যেও
বিশাল আকার শরীর নিয়ে
একটা আস্ত বটগাছ দাঁড়িয়ে গেলো।











অকবিতা 

০১ চাঁদ

পিঠের ’পর
প্রদীপ রেখে
সূর্যটি হেঁটে
যাচ্ছিলো

দেখছিলাম
সামনে থেকে
চাঁদের আলো
আমরা


০২ বাঁশি

গাঁয়ের তালপাখাটির হাওয়া
ঢুকলো ফুঁয়ের ভেতর,
এবার ফুঁ ঢুকলো কম্পনের ভেতর
পেছন দিয়ে, আর সামনে দিয়ে
বের হলো তোতাপাখি হয়ে,
পাখিগুলো উড়তে লাগলো
আকাশের নীলিমায়, সাগরের
নীলিমায়, বাঁশি হয়ে

ও আমার তোতাপাখি,
তুমি আমায় বাঁশি কর!











অতঃপর 

সূর্য-ছেলেটা আর মাকড়সার জালে ঝুলে নেই,
সে ফিরে পেয়েছে তার কাঙিক্ষত নদীতীর।
অমাবশ্যার অসুখ নিয়ে ফিরতো যে মেয়েটি,
ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে মুখভর্তি ফেনা তুলতো,
ভেষজ-হাত জলপট্টি করে সারিয়ে তুলতাম;
সেও ফিরে গেছে ফের বাগানবাড়ির ছাদের উপর,
পূর্ণিমার জোয়ারে নাচতে নাচতে সমুদ্রে ভেসে
ভেসে যায়।

সমুদ্র অনেক অনেক দূরের গান শুনতে পায়,
চক্ষুপল্লবও সমুদ্রের অনেক অনেক দূরে থাকি;
তবুও জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই সমুদ্র
দেখতে পাই,
আর তখনই সমুদ্র উহাদেরকে নিয়ে যায় মন্থনে,
গল্প বলা শেষ করে ফের তরঙ্গভরা জলরাশি
সেইমতো জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরের ঠিক ঠিক
স্থানটায় স্থাপন করে যায় উহাদের বেঁচে থাকবার
লিপ্সা ও জানালা দিয়ে বাইরে গড়ানো দৃষ্টি।

সূর্য-ছেলেটি নদীতীরে বসে বাঁশরী বাজায়;
পূর্ণিমার জোয়ারে ঝুলবে নাচবে মেয়েটির গান,
জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়বে আমাদের বেঁচে
থাকবার লিপ্সা- এক পলকে পলকে এইসব
ঘটিতেছে অবিরাম।











অশ্বডিম্ব ০১

ডুমোমাছিকে আজকের পড়া ধরতেই
গোঁ গোঁ শব্দ ফেনা তুলতে শুরু করলো;
মাছি কি শীবের গীত গাইতে শুরু করলো?
রূপবান যাত্রাপালার বোধন গীত এটা তবে?
নাকি বৃষ্টির পড়ছে? রোদের পড়া, পাখির
ডাক, হাওয়ার চলাচল? কি পড়ছে মাছি?

গোঁ গোঁ-র মানে অশ্বডিম্ব হয়। টাকাপয়সা
ছাড়া জীবন চলে না-র যথার্থ কি?

The Cow মাছিটিকে আজকের পড়া দিয়েছি;
The Ass মাছিটিকে পড়া দিয়েছি আজকের:
‘পুঁজিবাদ ঠ্যাং তুলে মুত্‌ছে নিজের মাথায়,
তারপর?’
তারপরই তো গোঁ গোঁ, আর গোঁ গোঁ-র
ভেতরে বসে স্বয়ং ঈশ্বর কাতরকণ্ঠে
নিজেরই জানাজায় শরিক হবার আহ্বান
জানিয়ে যাচ্ছেন। কোন অশ্বডিম্ব হয়!











অশ্বডিম্ব ০২

দগদগে ঘা রৌদ্রে মেলেছি গা,
আর ফোঁপাচ্ছি কুয়োর জল,
মেয়েগুলো ঈশ্বরের যতগুলো পা-
সব পায়ে
দু’হাতের পেতেছি আঁন্‌চল,
বোকা লোক যত সতই হোক
কেঁদেকেটে
বিষ করছি বুড়িগঙ্গার জল,
আকাশে হেলান দিয়ে ঘাম মাখছি
সাহসের দল
বাঁধ ভাঙার জোট- দুলতে থাকে কবির
নক্ষত্রের দঙ্গল 











অশ্বডিম্ব ভেঙে বের হয়ে 

বৃক্ষের তলে বাঁধিয়াছ বাস
আর চারদিক শুয়ে-ব’সে ঘাস
মুদ্রা রূপার জ্বলে চারপাশ
সারারাত হাঁটে শিশির-আকাশ

উড়িয়ে দিলাম অতিব প্রাতের
উড়িয়ে দিলাম দুপুরের গান
উড়িয়ে দিলাম ভর সন্ধের
উড়িয়ে দিলাম মধ্যেরাতের

গানের ভেতর পাখিদের স্বর
গান গিয়ে বসে তোমাদের ঘর

তোমাদের ঘরে টানা টানা চোখ
চোখের মণিতে বসে সেই লোক
লোকটার আছে সবুজ জমিন
সে তোমার যদি তবে তাই হোক











কবিতা এমন

খড়ের মাচার তলে পা ছড়িয়ে গল্প করতে থাকা ইঁদুরের যৌনগন্ধগুলো বৃষ্টির দিনে অবিরাম বয়ে চলা গড়াতে গড়াতে ভেসে বেড়ায় সারা মাঠ;- বাদল দিনের এমনই ব্যাখ্যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

খুব সকালে মদ্দামেয়ে খড়ের মাচার আড়ালে ব’সে মুতের গন্ধে ভাসিয়ে দ্যায় ঘুমিয়ে পড়া ইঁদুরের গর্তগুলো, আর ইঁদুরগুলো দৌড়তে থাকে, রাজহাঁসের একঝাঁকের পিছে পিছে গিয়ে দৌড়গুলো থমকে যায় দিঘির পাড়ে, আর দেখতে থাকে হংসমিথুনের ভাসতে ভাসতে ডুবে যাওয়া, আর ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠা যৌনগন্ধগুলো;- একটি সকালকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন জীবনানন্দ দাশ।

খড়ের মাচার তলের ইঁদুরের বিনিদ্র যৌনগন্ধগুলো জোছনা বেয়ে দৌড়ে দৌড়ে বৃক্ষদের পল্লবে মাথা রেখে দুলতে থাকে সারারাত, দুলতে দেখা যাবেই, আর দুলতে থাকার জন্য হাওয়া বইতে হবেই এমন কোন কথা নেই;- জোছনারাতের এমনই ব্যাখ্যা করেছেন প্রভাত চৌধুরী।

আর কবিতা পড়তে পড়তে সারারাতের বিনিদ্রসুখ বইয়ের পাতা থেকে ঝ’রে ঘর থেকে বেরিয়ে খড়ের মাচায় গিয়ে দোল খাচ্ছেন শামসুর রাহমান, আর রৌদ্রের গন্ধের ভেতর বাঁশি শুনছে বাংলাদেশ।















সময়

পথ ফেলে চলে গেছে একজোড়া ইস্কুল, ইস্কুল পাশের বটগাছটির ইচ্ছেরাও চলে গেছে, বটপাতায় থোকায় থোকায় ছায়াদের ঝুলে থাকারা আর পাখিদের সাথে হুটোপুটি খেলারা খেলতে খেলতে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া নদীটির চলাচলে ঝাপ দিয়েছে, ভেসে গিয়াছে পথ ফেলে ফেলে, আবার রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা নদীটির দুকূল- হায়! তাও তো ভেসে ভেসে চলিয়া গিয়াছে পথ ফেলে ফেলে।
আমাদের পথটি খুঁজে নিও ইহাদের পথে।
আহা! এখন দূর ডালে ঝড়ের মধ্যে একটি বায়স ভিজে ভিজে ধাতানি খাচ্ছে তাহার বায়সীর।
ঝড়ের মধ্যেটা বিচার তুলেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার, তুমুল বৃষ্টির ফোঁটা ফাঁসি দিচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর, লালন চত্বরে ফুলেদের কানে কানে বাঁশি শোনাচ্ছে পাখিরা।











বিকেল

চক্ষুচড়কগাছ, বিকেল তোমাকে শাড়ির আঁচলে দুলিয়ে দিয়ে চিনেছে তোমার মায়ের
অমল সুবাস,
বিকেল তোমাকে বাবার হাত ধরিয়ে দিয়ে হেঁটে গেছে অনেক পথ,
বিকেল তোমাকে ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে বৃক্ষের শাখায় বসিয়ে পা দুলিয়েছে।

চক্ষুচড়কগাছ, বিকেল তোমাকে নৌকায় ভাসিয়ে দুলতে দুলতে পৌঁছে গিয়েছে
বহুদূর,
বিকেল তোমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে বন্ধুদের সাথে ক’রে হাততালি দিয়েছে,
বিকেল তোমাকে মাথায় করে নাচিয়েছে ইস্কুল পরীক্ষায় ভালো করবার পর।

চক্ষুচড়কগাছ, বিকেল তোমাকে মনভালো হাওয়ায় বসিয়ে রেখে পাখিদের ডানায়
রৌদ্রের ওড়াউড়ি দেখেছে,
বিকেল তোমাকে মনখারাপ হওয়া ছাতার তলে বসিয়ে মাঠে মাঠে ভিজেছে,
বিকেল তোমাকে দূরপাহাড়ের সৌন্দর্যে ভিরমি খাইয়ে অকপটে বলেছে
কোন বয়েসী মেয়েদের বুকে কোন কুসুমের সৌরভ থাকে।

চক্ষুচড়কগাছ, বিকেল তোমাকে কাঁধে কাঁধ পায়ে পা মিলিয়ে মিছিলে নিয়েছে, আর
শ্লোগান দিয়েছে: শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই, শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই,
বিকেল তোমাকে সুউচ্চমঞ্চে দাঁড় করিয়ে জনতার বিশাল কাতারে ঘোষণা করেছে:
রাষ্ট্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই,
বিকেল তোমাকে সমুদ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে গলা ফাটিয়ে বলেছে:
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই।

চক্ষুচড়কগাছ, বিকেল তোমাকে পূবের মাচায় বসিয়ে পশ্চিমের বোঁটায় ঝুলছে,
বিকেল তোমাকে জলকাদার ভেতর নামিয়ে দিয়ে সারাপাড়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর
পানতামুক খেয়ে বেড়াচ্ছে।











ভবিতব্য 

ফ্যাকাশে পা দৌড়ে দৌড়ে
ধুলোর পথ ওড়ায়,
অকর্মন্য পুরুষ
মাথায় রাখছে হাত
পথের উপর ব’সে,
মাথায় হাত রাখারা
মাখে রোদন গীতিকা,
গানের ধুলো উড়ছে
মাঠের হাওয়া ঢেউ,
ঢেউ গিয়াছে আকাশে।

রাতের আকাশ বোঝে
শিশুর খিদের পেট,
পেটেরা ফুলতে থাকে
আকাশ শিশুর পেট,
পেটেরা আজ আকাশ।

আকাশে রাষ্ট্র নাই।











পোক 

মুখের ভেতর মাছি
খেলছে কানা ও মাছি!
চোখের ভেতর জোঁক
তুই কেমন হে লোক!
গলায় মালায় সাপ
খেইল দেখাস বাপ!
কানের ভেতর খেউ
এক বিছানায় সেও!
বুকের ভেতর কেউ
সাঁতার তুলছে ঢেউ।

ঘুমালো রাতে যে, লোক
সকালে সে অন্য, পোক।














বৈশাখ 

একটি বৈশাখ আম্রমুকুলের গানের আসরে গল্প বলতে গিয়েছিলো, গল্পবলা শেষ করবার আগেই মুকুলগুলো ঝরে পড়েছিলো ভোরের আলোতে। বৈশাখ তখন আমাদের সাথে পুকুর জলে নেমে গিয়েছিলো; তখন বৈশাখের ভেজা বুক আর বুকের বসন লেপ্টালেপ্টি হয়েছিলো, আর পুকুরের জল এই প্রথম দেখেছিলো কোন কিশোরীর স্তন, আমরা শুধু বলেছিলাম: ‘সুবানাল্লাহ, বৈশাখ তোমার ভালো হোক।‘ লজ্জায় লাল বৈশাখ একটি কাঠবিড়ালীর পিছে পিছে দৌড় দিয়েছিলো, কাঠবিড়ালীটা দৌড়াচ্ছিলো আমবনের ভেতর দিয়ে, আমবনের ভেতর কাঠবিড়ালী আর দৌড়তে থাকারা দেখতে পেলো থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা কিশোরীস্তন, কাঠবিড়ালীদৌড় ঝুলে থাকা থোকার ভেতর মুখ লুকালো, লম্বা লেজ বাইরে কেবল নাচছিলো, আর তার নাচছিলোগুলোকে দুহাত ভরে টানতে লাগলো বৈশাখ; যেই টান সেই বেড়েই যাচ্ছিলো লেজ, টানের সাথে বেড়ে উঠছিলো স্তনথোকা, দীর্ঘলেজ এবার বৈশাখকেই ঠেলে ফেললো জ্যৈষ্ঠের ভেতর। এই সুযোগে জ্যৈষ্ঠের মধুস্তন হতে সব দুধ ঝরিয়ে নিয়ে খেয়ে নিলো পাড়াপড়শীর গোঁফঅলা বিড়াল।
ডানাঅলা কবিদের ঝাঁক থেকে ডানা খসিয়ে কবি শিশির আজম বৈশাখকে ফিরিয়ে আনতে পারে যদি, তবে নিশ্চিত ঝেটিয়ে বিদেয় করবে পড়শীদের লোভী বিড়ালগুলোকে।
আহা বৈশাখ! আবার একসাথে পুকুর জলে নামবো, আহা পুকুরের জল!











একটি হেমন্তের কবিতা

উত্সর্গ: রমনাবৃক্ষদের পায়ে বসে ছেলেদের বুকে মাথা রেখে কাঁদে যে সব প্রেমিকারা

হেসেখেলের মাথার উপর চাবুক ঘোরাচ্ছিলো একটি হেমন্তকাল,
আর রাখাল-সময় শালিক পাখির ঝাঁক ছেড়ে দৌড়াচ্ছিলো
মাঠ পেরিয়ে,
আর পেরোতে পেরোতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো
একটি ঘুঘুপাখির ঝোপ,
ঝোপ আর ঘুঘুপাখি বসেছিলো একদুপুরের ডালে,
এই মেয়ে! তোমার টিপটি সুন্দর, তুমি তবে
তবে তুমি শুনতে পেয়েছো ঘুঘুপাখির ঠিক দুপুরের গান।

বেতবনের ভেতর থেকে যে বাঘগুলো জলপানে নেমে আসতো
পাশের নদীতে,
বাঘের জিভের উঠানামা থেকে গড়িয়ে পড়তো যে বৃত্তকার তরঙ্গগুলো,
তরঙ্গমালা ভেসে বেড়াতো সারা নদীতে, তা থেকে জানা যায়:

বেতবনের ভেতর ভয়গুলো নিদ্রা যেতো,
আর খিদে পেলে চুপিচুপি বের হয়ে ঘাড় মটকে আহার করতো
দলছুট দুএকটা হরিণ,
বেতবনকে ঘিরে রাখতো যে বৃক্ষগুলো, রোদ্দুর প্রতিদিন বসতো
তাহাদের পাতার উপর,
পাতাদের উপর বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে ফিরে যেতো নিজেদের
নিরালা নৌকোয়,
এই মেয়ে! তোমার পা দুখানি ভারি সুন্দর, সারারাত দুলতে থাকে
নায়ের উপর,
রোদ্দুর বেতবনের ভেতর ঢুকতে সাহস পেতো না,
শুধু ঝমঝমানো বৃষ্টিরা ঢুকতে পেতো,
আর বৃক্ষদের সারা গায়ে গড়াতে পারতো শ্যামল শ্যাওলারা,
দুএকটা গানের পাখি উচ্চডালে বসে নিবেদন করে যেতো গান
তার প্রেমিকার পায়ে,
বৃক্ষদের ডালে ডালে এক ঝাঁক পেচা ঝগড়াঝাটি করতে পারতো,
দুএকটা বানরছানা লাফিয়ে পড়তো বেতবনের উপর,
আর হুলস্থুল দাপিয়ে উঠতো, আর বাতাস ফালা ফালা হয়ে যেতো,
আর ভীতুরডিম কচ্ছপ বন হতে গুপিগুটি পায়ে বের হয়ে
নেমে আসতো নদীতে,
কচ্ছপের পা থেকে সাঁতার দিয়ে ডাঙায় ওঠা বৃত্তকার তরঙ্গমালাগুলো
ভেসে বেড়াতো সারা নদীতে,
সেই তরঙ্গমালা থেকেও জানা যাবে:

পেঁচাদের ঝগড়াঝাটিতে একদিন নদী পার হয়ে গেলো বাঘেরা,
আর ফিরতে পারলো না,
এবার রোদ্দুর ঢুকতে পারলো বেতবনের ভেতর,
বানরশিশু খেলতে আসে রৌদ্রের ভেতর, গল্প বলে রোদের সনে,
গল্প বলতে বলতে নদী পার হয়ে যায়, আর ফিরতে পারলো না,
একদিন হেমন্তের ভেতর দিয়ে পেঁচার ঝাঁক উড়তে উড়তে
কতকগুলো পালক ভাসিয়ে গেলো নদীর জলে,
পালকের ভেতর যে তরঙ্গমালা ঘুমিয়ে ছিলো, তা পালক ছড়িয়ে
সারা নদীতে ভাসতে লাগলো, এ তরঙ্গমালা থেকেও জানা যাবে:

কয়েকটা বনবিড়ালের গোঁফ, কয়েকটা গোবেচারা সজারুর কাঁটা,
আর রাতগড়ানো সাপেদের জড়াজড়ি করা ফোঁসফোঁস
শুনতে আসতো কয়েকটি মাছরাঙা নদীর জলে নামার আগে আগে,
এই মেয়ে! তোমার চোখ সুন্দর, জলে নামার আগে মাছরাঙাদের
সাথে নিয়মিতই দেখা হয় তোমার।

মাছরাঙাদের জলে নামা সাঁতার গড়াতে থাকে সারা নদীর অঙ্গে,
গড়াতে থাকাগুলোকে অতিক্রম ক’রে একটি সকাল
তোমাকে নিয়ে গেলো বেতবনের ভেতর,
বেতবনের ভেতর জামাকাপড় খুলে হুহু দৌড়াচ্ছে বাতাসেরা,
তোমার বুকের ভেতর কী যে তোলপাড় তখন,
কী যে তোলপাড়, তোলপাড়গুলো ভাসিয়ে না নিলেও পারো নদী!
এই মেয়ে! তোমার তোলপাড় বুক সুন্দর।
আহা কী যে সুন্দর! আহা কী যে সুন্দর তুমি তরঙ্গমালা।